যুবকদের দক্ষ করে তুলতে ফলমুখী সমবায়ী শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ প্রধান উপদেষ্টার
ঢাকা, ওপেন প্রেস ডেস্ক : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ বৃহস্পতিবার ডিজিটাল বিপ্লবের পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করে তরুণদের দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ফলমুখী সংযোগ গড়ে তোলার এবং সমবায়ী শিক্ষা প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছেন। খবর বাসস।
তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও সমমানের জ্ঞান বিতরণী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকর ও ফলমুখী সংযোগ তৈরি ও তা গভীর করতে হবে। বিশেষ করে ফলিত বিজ্ঞান শাখার ছেলে-মেয়েদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রস্তুত করায় মনোনিবেশ করতে হবে।’
আজ এখানে প্রাপ্ত এক বার্তায় বলা হয়, মিশরে রাজধানী কায়রোতে ১১তম ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধান উপদেষ্টা একথা বলেন।
তিনি বলেন, ডি-৮ সদস্য দেশগুলোকে উদ্যোক্তা ও উচ্চতর শিক্ষার মধ্যে আজকের দূরত্ব ঘুচিয়ে আরও কাছাকাছি আনতে হবে। তাদের লক্ষ্য হতে হবে এই শিক্ষা থেকে অর্জিত জ্ঞানের ডি-৮ দেশগুলোর নেতাদের বৈশ্বিক ব্যবসা ও শিল্পের তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারের টিকে থাকা নিশ্চিত করতে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
তিনি আরও বলেন, ‘যদি এতে ডি-৮ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কাঠামোকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে বলে, তবে আমাদের তা-ই করা উচিত। ব্যবসাকে শুধু সম্পদ গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে না দেখে এটি যেন মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে সেভাবে রূপান্তরিত করতে হবে। তারা একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে সামাজিক ব্যবসায় সম্পৃক্ত হবেন।’
২০০৬ সালের নোবেল শান্তি বিজয়ী বলেন, দ্বিতীয়ত, ডি-৮ দেশগুলোতে তারা বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে লাখ লাখ লোককে মৌলিক শিক্ষা ও দক্ষতা প্রদানের চেষ্টা করেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘১.২ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে, এটি প্রায়শই একটি কঠিন কাজ। উদাহরণস্বরূপ ‘মানদণ্ডে’ পৌঁছানোর জন্য আমরা দূরশিক্ষণের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি। কীভাবে কর্মক্ষেত্রে লাখ লাখ যুবককে দক্ষ করা যায় তা নিয়ে আমাদের আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। কর্মক্ষেত্রেও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাও কঠোর দক্ষতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘এবং এছাড়াও আমরা বিভিন্ন বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে লাখ লাখ লোককে পুনরায় দক্ষ করে তোলার চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন।’
মৌলিক এআই-ভিত্তিক সরঞ্জাম এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলো এখন নাগালের মধ্যে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস ডি-৮ নেতাদের একটি সমবায়ী শিক্ষা এজেন্ডা বিবেচনা করার আহ্বান জানান, যা তাদের জাতীয় অঙ্গীকারের পরিপূরক হতে পারে।
তিনি বলেন, যুব উদ্যোক্তাদের বিশ্বের মতই ‘কাজের বিশ্ব’ও যেভাবে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, ডি-৮ দেশগুলোকে তাদের ছেলে-মেয়েদের অর্থনীতির নেতা হওয়ার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে নতুন ধরনের ‘শিক্ষা’ উদ্ভাবন করতে হবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের দেশগুলোর মহান ঐতিহ্য, প্রজ্ঞা ও কৃতিত্ব রয়েছে। আমাদের দেখতে হবে যে, কীভাবে আমরা সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে নতুন কিছু গড়ে তুলতে পারি। বছরের পর বছর ধরে যে ডিজিটাল বিপ্লব চলছে, আমরা এখনও তার পুরো সুবিধা নিতে পারিনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন যেহেতু এআই সুলভ হয়েছে, তাই আসুন আমরা আমাদের উদ্যোক্তা ছেলে-মেয়েদের সুবিধার জন্য এক্ষেত্রে বাধাগুলো মোকাবিলা করতে পারি কি না, তা ভেবে দেখি। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে, আমি আমাদের বিবেচনার জন্য দুটি নির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রস্তাব করতে চাই।’
ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ডি-৮ নেতারা এমন এক সময়ে মিলিত হয়েছেন যখন বিশ্ব অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ প্রত্যক্ষ করছে, যখন অনেক সুযোগ তাদের ইঙ্গিত করছে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, যুব এবং এসএমইকে কেন্দ্র করে সামিটের থিম আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যথাযথভাবে অনুরণিত।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, ডি-৮ দেশগুলির প্রত্যেকের মতো বাংলাদেশে তরুণ জনসংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে তাদের বয়স মাত্র ২৭ বছর। তিনি বলেন, প্রতি বছর প্রায় আড়াই মিলিয়ন তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে।
‘বেসরকারী খাত চালিত অর্থনীতিতে, যখন আমরা তাদের বাজারের জন্য উপযুক্ত করার চেষ্টা করি বা তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে উৎসাহিত করি, আমরা দেখতে পাই যে প্রযুক্তির উত্থান কীভাবে চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ তৈরি করছে যা আগে কখনও হয়নি,’ তিনি যোগ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশগুলিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ কর্মী রয়েছে- যাদের সাধারণত কম দক্ষতা রয়েছে তবে আগামীতে উৎপাদন এবং পরিষেবা অর্থনীতি দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে, যা মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ডেটা-চালিত সরঞ্জাম এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলির ওপর নির্ভর করে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষি এখনও সমাজ ও অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, সেখানে দেখা গেছে যে অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষকের সন্তানরা তাদের পিতামাতার মতো মাঠে-ঘাটে ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রায়শই অনিশ্চিত চাষাবাদ করতে আগ্রহী নয়।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, গ্রামীণ বাংলাদেশে ভ্রমণ, এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা এবং আরব বিশ্ব জুড়ে, তিনি দেখেছেন কিভাবে আজকের লাখ লাখ তরুণ চারপাশের সবকিছুতে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনকে দ্রুত গ্রহণ করছে, যা দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে অথবা নতুন নতুন সুযোগ খুঁজে বের করছে। কয়েক বছর আগেও যা অনেকে অসম্ভব ভেবেছিলেন।
তিনি বলেন, প্রায়শই মাঠের মধ্যে জলবায়ু সংক্রান্ত জটিল সমস্যা মোকাবেলায় তরুণরা অদ্ভুত কল্পনা দেখায়।
তিনি যোগ করেন, ‘আমি বিশেষ করে এটিকে আন্ডারলাইন করছি কারণ আমাদের কৃষি এবং খাদ্য আমাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করতে এবং আমাদের নিজস্ব সমাজের মধ্যে, সামান্য বাইরের ইনপুটসহ সম্পদ তৈরি করার বিষয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে।’
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) গুরুত্ব সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি তাদের লক্ষ লক্ষ এসএমইকে বিবেচনায় নিয়ে আসে এবং তাদের বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির মধ্যে উন্নতি করে।
তিনি বলেন ‘তারা বেড়ে উঠতে এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে সংযুক্ত হতে চায়। প্রায়শই, তাদের আনুষ্ঠানিক কাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন বা সহায়তা কাঠামোর অভাব থাকে এবং বাজারের নিয়ম-অনুশীলন-মানগুলির সাথে অপরিচিত। তবুও, আমি দেখতে পাচ্ছি যে এসএমইগুলি কতটা আশ্চর্যজনকভাবে সক্ষম এবং প্রতিযোগিতামূলক’।
তিনি বলেন, ডি-৮ দেশগুলিতে এইসব এসএমইগুলির পাশে দাঁড়ানোর জন্য সমষ্টিগতভাবে তারা যথেষ্ট সম্পদের অধিকারী, এমনকি ব্যক্তিগত পরোপকারেও।
‘আমাদের পরিমিত সমর্থনের মাধ্যমে, আমরা তাদের জন্য এবং আমাদের জনগণের জন্য একটি ‘ভালোর বলয়’ গড়ে তুলতে পারি । ‘আমাদের দরকার ঝুঁকিমুক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে তাদেরকে অর্থ দেয়া,’ নোবেল বিজয়ী বলেন।
তিনি ডি-৮ সরকারগুলিকে স্টার্টআপস – ব্যবসা – অর্থায়নের সাথে জড়িত অকপট যুব সম্প্রদায়ের ফলাফলমুখী কথোপকথনের আহ্বান জানাতে বলেন। এতে তারা তাদের মধ্যে নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পেতে পারেন।
প্রফেসর ইউনূস দৃঢ়তার সাথে বলেন যে বাংলাদেশ এ ধরনের উদ্যোগ এগিয়ে নিতে এবং ২০২৫ সালে প্রথম মাল্টি-স্টেকহোল্ডারদের সভা আহ্বান করতে প্রস্তুত থাকবে।
উপসংহারে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা আমাদের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা এবং জরুরি ইস্যুগুলির জন্য অঙ্গীকার প্রতিফলিত করতে কায়রো ঘোষণা এবং শীর্ষ সম্মেলনের ফলাফল গ্রহণ করি। আমি নেতাদের আমাদের সম্মিলিত এজেন্ডাকে নতুন করে দেখার জন্য আহ্বান জানাতে পারি।
অনুষ্ঠানে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ ইএল-সিসি, ডি-৮ সদস্য রাষ্ট্রের নেতারা এবং ডি-৮ মহাসচিব উপস্থিত ছিলেন।