মহামারী মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও সাড়াদানে উচ্চ-পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অপরিহার্য : প্রধানমন্ত্রী
ঢাকা, ওপেন প্রেস ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা স্থাপন, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদক্ষেপে আস্থা তৈরি এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে মহামারী মোকাবেলায় প্রস্তুতি এবং সাড়া প্রদানের জন্য উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। খবর বাসস।
তিনি আজ ৭ মে, ২০২৪, মঙ্গলবার বলেন, ‘মহামারী প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত সংস্কার পরিচালনার ক্ষেত্রে উচ্চ-স্তরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অপরিহার্য। এটি বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার জন্য আওয়াজ তোলে, জনস্বাস্থ্যের হস্তক্ষেপে আস্থা জাগিয়ে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত জীবন বাঁচায়।’
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং মহামারী প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়ার জন্য স্বাধীন প্যানেলের কো-চেয়ার হেলেন ক্লার্কের সাথে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে এ বক্তব্য উত্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যত মহামারীজনিত জটিলতা মোকাবেলা করার সময় আরও স্থিতিস্থাপক এবং প্রস্তুত বিশ্ব গঠনে আমাদের একটি শক্তিশালী এবং সিদ্ধান্তমূলক নেতৃত্ব অপরিহার্য হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অত্যন্ত খন্ডিত বিশ্ব স্বাস্থ্য শাসন ব্যবস্থাকে মহামারী প্রতিরোধ ও সাড়াদানের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জ্ঞান, প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সক্ষমতা জোরদারে আমাদের অবশ্যই সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেন যে, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় অতীতের সাফল্য বিবেচনা করে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।
তিনি আরও মতামত দেন যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পৃক্ততা এবং প্রতিশ্রুতি পদ্ধতিগত পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য যা ‘আমাদের ভবিষ্যতের মহামারী প্রতিরোধ, সনাক্তকরণ এবং কার্যকরভাবে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা’ বাড়াতে পারে।
শেখ হাসিনা বলেন, মহামারী প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় একটি অগ্রাধিকার থাকে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা নিশ্চিত করেন ।
তিনি আরো বলেন, এটি আর্থিক সংস্থানকে একত্রিত করতে সহায়তা, দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতাকে উৎসাহিত এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের জন্য আমাদের অভিন্নর অঙ্গীকার অর্জনের জন্য জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে কোভিড-১৯ একটি বৈশ্বিক জাগরণ আহ্বান, যা আন্তর্জাতিক মহামারী প্রস্তুতি ও সাড়াদানের ব্যাপক সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।
তিনি উল্লেখ করেন, এই মহামারী আমাদের দেখিয়েছে যে আমরা সবাই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। আমরা সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই সত্যিকারের নিরাপদ হতে পারব না।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-৩ এবং লক্ষ্য-১৭-এ বর্ণিত জনস্বাস্থ্য লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য এখন বিশ্বব্যাপী একসঙ্গে কাজ করার সময়। তিনি বলেন, এর মধ্যে রয়েছে কম সম্পদযুক্ত দেশগুলোর স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের দক্ষতা উন্নত করতে সহায়তা করা।
প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দেওয়ার জন্য স্বাধীন প্যানেলের কো-চেয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ এবং হেলেন ক্লাককে ধন্যবাদ জানান ।
তিনি উল্লেখ করেছেন যে কোভিড-১৯ এর শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা এবং ন্যায্যতা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে মহামারী প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়ার জন্য একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বেও কথা বলে ।
তিনি বলেন, ভবিষ্যত মহামারীর প্রভাব প্রশমিত করতে এবং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এই শিক্ষার একটি অর্থপূর্ণ প্রয়োগ অপরিহার্য হবে।
বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি সুপারিশের ওপর জোর দেন:
তিনি বলেন, প্রথমত, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট কার্যকরভাবে মোকাবেলায় তথ্য, দক্ষতা এবং সম্পদ বিনিময়ের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও যৌথ প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
টিকা প্রাপ্তিতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে তীব্র বৈষম্য প্রকাশ পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি তার দ্বিতীয় সুপারিশে বলেন, এই বৈষম্য দূর করার জন্য টিকা, ডায়াগনস্টিকস এবং চিকিৎসার ন্যায়সঙ্গত বিতরণ এবং লভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
শেখ হাসিনা তৃতীয় সুপারিশে বলেন, কোভিড-১৯ মানুষ, প্রাণীজগত ও পরিবেশগত স্বাস্থ্যের আন্তঃসম্পর্ককে তুলে ধরেছে। তিনি বলেন, ওয়ান হেলথ পদ্ধতি অবলম্বন করা, যা মানুষ, প্রাণীজগত এবং বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যকে আন্তঃসংযুক্ত হিসাবে বিবেচনা করে ভবিষ্যতের মহামারী প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের দ্রুত বিকাশমান মহামারী প্রস্তুতির জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগের গুরুত্ব আরোপের উলে¬খ করে তিনি তার চতুর্থ সুপারিশে বলেন, নতুন এবং মারাত্মক সংক্রামক রোগ মোকাবেলায় টিকা, থেরাপিউটিক্স এবং ডায়াগনস্টিক্সের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে অব্যাহত বিনিয়োগ অপরিহার্য।
প্রধানমন্ত্রী পরিশেষে উল্লেখ করেন যে প্রস্তুতিমূলক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য পর্যাপ্ত এবং টেকসই অর্থায়ন ব্যবস্থা প্রয়োজন, যার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সরবরাহের মজুদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে সক্ষমতা বৃদ্ধি।
শেখ হাসিনা বলেন, গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা মূল্যায়নের ফলাফল এবং অতীতের জরুরী অবস্থা থেকে অর্জিত শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ ক্রমাগত তার প্রস্তুতি ও সাড়াদানের ক্ষমতা জোরদার করেছে।
তিনি বলেন অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ মহামারী পর্যবেক্ষণ, প্রস্তুতি, সাড়াদান এবং স্থিতিস্থাপকতার জন্য সংকল্পের পরীক্ষা ছিল।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ দেখায় যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় পূর্বের বিনিয়োগ খুবই উপযোগী ছিল কারণ দেশটি দ্রুত বিদ্যমান প্রস্তুতি এবং সাড়াদানের পরিকল্পনা, নজরদারি প্ল্যাটফর্ম, পরীক্ষাগার এবং জরুরি সাড়াদানের জন্য কর্মীবাহিনীকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দ্রুত রোগ নির্ণয়ের জন্য ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ককে দ্রুত সম্প্রসারণ করতে পারে এবং সহজলভ্য ক্লিনিক্যাল কেয়ার প্রদান করতে পারে।
এই শিক্ষার উপর বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে, তাঁরা এখন ভবিষ্যতের মহামারী, যার মধ্যে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের মতো নীরব মহামারী রয়েছে এবং জরুরী অবস্থার প্রতিরোধ, সনাক্তকরণ এবং আরও ভালভাবে সাড়া দেওয়ার জন্য তাঁদের প্রচেষ্টাকে সর্বাধিক করে তুলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডব্লিউএইচও দ্বারা প্রত্যয়িত কোভিড -১৯ ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিছু প্রাথমিক বাধা সত্ত্বেও, তারা শেষ পর্যন্ত তাদের লক্ষ্য জনসংখ্যার ১০০ শতাংশেরও বেশি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টিকা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে, তিনি যোগ করেন।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন যে তার সরকার চারটি ধাপে মোট ৩৬৬.৮৭ মিলিয়ন ডোজ টিকা প্রদান করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমি ভ্যাকসিনকে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের পণ্য হিসাবে বিবেচনা করার জন্য এবং নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর কাছে অগ্রাধিকারের বিষয় হিসাবে উপলব্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছি,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশে, প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরা একটি সাশ্রয়ী উপায়ে ভ্যাকসিন গবেষণা এবং উৎপাদনে অবদান রাখার অবস্থানে রয়েছেন।
তিনি উল্লেখ করেন যে অন্যান্য নীতি সহায়তা ব্যবস্থার পাশাপাশি তিনি ইতোমধ্যে একটি অত্যাধুনিক ভ্যাকসিন গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য এক টুকরো জমি বরাদ্দ করেছেন।
তাঁর সরকার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের প্রবাসীদের খাদ্য ও নগদ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে,’ উল্লেখ তিনি বলেন, ‘আমরা অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে ভারত ও চীনে আটকে পড়া আমাদের নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁরা সংহতির মনোভাব নিয়ে আরও কয়েকটি দেশকে মানবিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য মালদ্বীপে নার্স পাঠানোর মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, আমরা কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গাকেও টিকা দিয়েছি।
পাশাপাশি তিনি আরো বলেন তাঁর সরকারকে বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তির নির্বিচারে বিস্তার প্রতিরোধ করার জন্য একটি ব্যাপক সচেতনতা প্রচার চালাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী ২০২০ সালের প্রথম দিকে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আঘাত হানে।
তিনি বলেন, “তবে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের দীর্ঘদিনের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা এবং সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে আমরা মানুষের প্রাণহানি কমিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি।”
‘আমাদের জীবন বাঁচানো এবং জীবিকা রক্ষার মধ্যে একটি ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়েছিল,’ তিনি যোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে তাঁর সরকার শিল্পের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য উদ্দীপনা প্যাকেজ এবং নি¤œ আয়ের এবং প্রান্তিক মানুষের জন্য একটি ব্যাপক সামাজিক সুরক্ষা পোর্টফোলিও চালু করেছে।
সরকার শিল্প ও ব্যবসায়ীদের জন্য উদ্দীপনা প্যাকেজ হিসাবে ২৭.৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রনোদনা প্রদান করেছে, সমাজের প্রান্তিক অংশ যেমন দিনমজুর, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বিক্রেতা, স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের জন্য।
কোভিড -১৯ মহামারী চলাকালীন প্রায় ৭৮.৫ মিলিয়ন মানুষ সহায়তা থেকে উপকৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এছাড়াও আমাদের দলের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, বিত্তশালী মানুষ, ব্যবসায়ীরা খাবার, ওষুধ ইত্যাদি দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রচেষ্টার ফলে, সামগ্রিক কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা এবং পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।’