রাজনীতি

তারেক রহমান : ধ্বংসস্তূপ থেকে বিস্ময়কর উত্থান

ঢাকা, (২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫) ওপেনপ্রেস২৪ ডেস্ক : মাহবুব মোর্শেদ ।। বাসস

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা-মুহূর্তে বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছিল মেজর জিয়াউর রহমানের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক ইতিহাস রচয়িতা মেজর জিয়াউর রহমানের এই উত্থানের তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। তারা বুঝতে পারেননি, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ছিল।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। বিশেষ করে আইয়ুব খানের দীর্ঘ সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সামরিক বাহিনী বিশেষ ভূমিকা নিতে শুরু করে। তাদের এই নির্ধারক ভূমিকার কারণে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে নয়, পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ ও রাজনীতিও বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। এ কারণে বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা কী সে প্রশ্ন জনমনে সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে, সেনাবাহিনীর বাংলা ভাষাভাষী অংশগুলো কোন পক্ষ গ্রহণ করবে এ প্রশ্ন খুবই জরুরিভাবেই উত্থাপিত হয়েছিল।

মেজর জিয়াউর রহমান ২৫ মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর এ প্রশ্নের সময়োচিত ও মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন, স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। তার সেই ঘোষণা থেকে বাংলাদেশের সকল মানুষ মুহূর্তেই সজাগ হয়ে উঠেছিল। সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার মূল্য স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক ইতিহাস রচয়িতারা ভুলে গেলেও ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষ ঠিকই এর তাৎপর্য অনুভব করতে পেরেছিল।

তারা বুঝতে পেরেছিল, সেনাবাহিনীর বাংলা ভাষাভাষী অংশটি স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে নেমে গিয়েছে। তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। অনেকেই এই ঘোষণাকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু একাত্তরের প্রেক্ষাপটে ওই ঘোষণার মূল্য ছিল বিশাল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিপর্যস্ত জনগণ মুহূর্তে বুঝে গিয়েছিল, সশস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি পেশাদার বাহিনী তাদের সঙ্গে আছে। ফলে যুদ্ধ শুরু করতে আর কোনো দ্বিধার অবকাশ নেই।

স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, জেড ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বীরের সম্মান পেয়েছেন। যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশের সকল পেশাদার সৈনিক ও কর্মকর্তাদের মতো তিনিও নিয়মিত সামরিক পেশায় ফিরে গিয়েছেন। পরে ক্রমশ পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন এবং সামরিক বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

পরে আরেক ঐতিহাসিক মুহূর্তে তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। নানাবিধ বিশৃঙ্খলা ও প্রায় বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করেছিলেন।

রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হিসেবে তিনি সময় পেয়েছিলেন খুবই অল্প। একদিকে রাজনীতির বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তাকে সামাল দিতে হয়েছিল, অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর মধ্যকার বিশৃংখলা প্রশমিত করে একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করার চ্যালেঞ্জও তাকে নিতে হয়েছিল।

রাজনীতিক হিসেবে তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, বহু বছরের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ তৈরি করা এবং সেই মতাদর্শে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটানো। একজন সামরিক বাহিনীর পেশা থেকে সরাসরি রাজনীতিতে এসে এটি করা তার জন্য সহজ ছিল না।

সবচেয়ে বড় কথা তার সময় ছিল অনেক কম। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজনৈতিক দল অনেকেই করতে পারে কিন্তু আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো একটি নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শ গড়ে তোলার অত্যন্ত কঠিন কাজটিও তিনি সাফল্যের সঙ্গে করে ফেলেন।

অনেকেই মনে করেন, প্রতিভা, ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও সকলকে নিয়ে কাজের মানসিকতা রাজনীতিতে তাঁর পথ খুলে দেয়। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামে একটি রাজনৈতিক দল ও মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক মতাদর্শের পত্তন ঘটাতে সক্ষম হন। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বহুদলীয় গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরির পাশাপাশি নিজের দলের জন্য মধ্যপন্থী ও ইনক্লুসিভ রাজনীতির সূচনা ঘটান।

কিন্তু আজকে বিএনপি নামে যে বিশাল দলটি আমরা দেখতে পাই সেই দলটির পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ঘটেনি। তার জীবৎকালেই নানা অন্তর্দলীয় কোন্দল দলটিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। নানা মতের মানুষকে একটি রাজনৈতিক লাইনে নিয়ে আসার জন্য তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাজটি তিনি শেষ করতে পারেননি। তাঁর অসমাপ্ত কাজটি করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।

একজন গৃহবধূর ভূমিকা থেকে খালেদা জিয়ার উত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেক বিস্ময়কর ঘটনা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর অন্তর্দলীয় কোন্দলে দিশাহারা বিএনপি’র দায়িত্ব নিয়ে তিনি দলটিকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনেন। দলের মধ্যকার নানামতের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির কাজ করেন সফলভাবে। বছর দুয়েকের মধ্যে খালেদা জিয়া জনগণের পক্ষ থেকে আপসহীন নেত্রীর উপাধি লাভ করেন।

স্বৈরাচারী শাসকের ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাবের কারণে তিনি এই উপাধি পান এবং একই কারণে তিনি তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার নেতৃত্বে ছাত্রদল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করে এবং খালেদা জিয়া, বিএনপি ও ছাত্রদলের কারণে বাংলাদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় এবং খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হন।

রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে জিয়াউর রহমান অল্প সময় থাকলেও এই সময়ের মধ্যে সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে দ্বিধা করেননি। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে একটা মধ্যপন্থী মতাদর্শের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব কারণে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় শহীদ হওয়ার পর জিয়াউর রহমান দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় একজন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে বিএনপিকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেন। অন্তর্দলীয় কোন্দলে বিএনপি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে, দলের অনেক নেতা এরশাদের সঙ্গে যুক্ত হন। অনেকেই বলেন, বিএনপি তখন একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে বিএনপিকে আবার টেনে তোলেন বেগম খালেদা জিয়া। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বিএনপি আবারও রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে। এই প্রত্যাবর্তন ছিল সবার জন্য বিস্ময়কর। কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, নানা মত ও পথের মানুষ বিএনপিতে যুক্ত থাকলেও বেগম খালেদা জিয়া শহীদ জিয়ার পথ ধরে বিএনপিকে আবারও মধ্যপন্থী ও ইনক্লুসিভ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। আজ আমরা বড় দল হিসেবে যে বিএনপিকে দেখি, সেটি খালেদা জিয়া পুনর্র্নিমাণ করেছেন। বিএনপি’র মতাদর্শ হিসেবে যা আজ দেশে পরিচিত সেটিরও পুনর্র্নিমাণ করেছেন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে বাংলাদেশে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে, শহুরে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগবান্ধব দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের পর আবারো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বিএনপি। ওয়ান ইলেভেনের অনেক আগে থেকেই বিএনপিকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় দলটির নেগেটিভ ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছিল সুকৌশলে। বিএনপি’র বিরুদ্ধে শক্তিশালী ন্যারেটিভ তৈরি করা হচ্ছিল। বিশেষ করে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার উত্তরসূরি তারেক রহমানকে ভিকটিমাইজ করার পথ ধরেছিল মিডিয়াগুলো। তাকে ডেমনাইজ করার একটি প্রকল্প খুব সচেতনভাবে চালানো হয়। এরই পরিণতিতে এক সময় তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার জেল ও নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে হয়। কিন্তু,তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের যত অভিযোগ বিরোধীদের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল সেগুলোর একটিও আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে প্রমাণ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ তার দেশী-বিদেশি দোসরদের সঙ্গে নিয়ে তিন তিনটি নির্বাচন ডাকাতি করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে জোরপূর্বক নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। বিনা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় নিশ্চিত করে প্রহসনের একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালে সকল দলের উপস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাতের বেলা নজিরবিহীন ভোট চুরির নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা।

শুধু পরপর তিনটি নির্বাচন ডাকাতি করার মধ্য দিয়েই যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল তা নয়। বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। অসংখ্য নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছিল। অনেককে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছিল।

এমনকি বেগম খালেদা জিয়াকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল।

তারেক রহমানের জন্য এই পরিস্থিতি ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। অনেকেই ভেবেছিলেন এই বিপর্যয় থেকে বিএনপি উঠে দাঁড়াতে পারবে না। বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান সুদূর লন্ডন থেকে দলের হাল কীভাবে ধরবেন এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। তারেক রহমানের জন্য পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন ছিল।

প্রথমত, বিএনপি’র বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তার দেশি-বিদেশি সহযোগী শক্তিগুলো শক্ত অবস্থান নিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা এবং অমানবিক কারাবাসের কারণে তার অনুপস্থিতিতে দলের নেতাকর্মীরা তারেক রহমানের নেতৃত্ব মেনে নেবেন কিনা এই প্রশ্ন ছিল।

তৃতীয়ত, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামীপন্থীদের ন্যারেটিভ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল।

চতুর্থত, দেশ থেকে বহুদূরে লন্ডনে তারেক রহমানের অবস্থানের কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাও এ ধরনের আশঙ্কা তৈরি করেছিল।

পঞ্চমত, আদালতের রায়ের মাধ্যমে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞার কারণে পাবলিক পরিসরে তার বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচারিত হতে পারছিল না।

এই পাঁচটি চ্যালেঞ্জের বাইরেও আওয়ামী লীগ সকল প্রক্রিয়ায় বিএনপির মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। সম্ভব সকল প্রক্রিয়ায় দল ভাঙার চেষ্টা করেছিল। শুধু সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তারা বসে থাকেনি, বরং নানা প্রক্রিয়ায় বিএনপির ওপর সাইবার নজরদারি বাড়িয়েছিল। এ কারণে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে তারেক রহমানের যোগাযোগ স্থাপন শুধু দুরূহ ছিল না, প্রায় অসম্ভব ছিল। বিএনপি’র ভেতরের খবর দ্রুত বাইরে চলে আসছিল। দলটির কর্মসূচি ও কৌশল ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল।

এরকম বৈরী পরিস্থিতিতেও তারেক রহমান অত্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে সবগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন।

ধীরে ধীরে তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিরোধীরা যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল তা তিনি ভেঙে দিয়েছেন। বিরোধীরা প্রচার চালিয়েছিল, তিনি রুক্ষ, বদমেজাজি ও নিষ্ঠুর একজন মানুষ। কিন্তু অনলাইন উপস্থিতিতে দলের নেতাকর্মীরা তাকে আবিষ্কার করেছেন একজন সহনশীল, সজ্জন ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে। আওয়ামী লীগ এবং বিরোধীরা তাকে দানবীয় একটি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বিপরীতে তার যে ইমেজ সামনে এলো তা বিস্ময়করভাবে নমনীয় ও মানবীয়। শুধু নেতাকর্মীদের মধ্যে নয়, যখন তার বক্তব্য পাবলিকলি প্রচারিত হতে শুরু করল তখন দেশের মানুষও জানতে পারলো তারেক রহমানের ব্যক্তিগত ইমেজের এই সহনশীলতা ও নমনীয়তার কথা।

দীর্ঘদিন তার বক্তব্য সামনে আসতে পারেনি। নানামাত্রিক নজরদারির কারণে তাকে সতর্কভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়েছে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। কিন্তু এই যোগাযোগ এক বিস্ময়কর পরিবর্তন এনে দিয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, অনুপস্থিতি ও কারাবাসের কারণে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল তা তিনি দ্রুতই পূরণ করতে পেরেছেন। এজন্য তাকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়েছে। দেশের সময় এবং লন্ডনের সময় মিলিয়ে একের পর এক মিটিং ও ফোন কল করতে হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে নয় বরং বছরের পর বছর এই রুটিন অবলম্বন করে কঠোর পরিশ্রম করে তিনি বিএনপির মধ্যে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

এ কথা সত্য, মধ্যপন্থী ও ইনক্লুসিভ দল হিসেবে বিএনপিতে নানা মতের ও নানা পথের মানুষের সমাগম ঘটেছে। তাদের অবস্থান অনেক বিষয়েই পরস্পর বিরোধী। শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও এমন প্রবণতা আছে। তারেক রহমান নানা মত ও নানা পথের মানুষের কথা শুনেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যপন্থী একটা অবস্থানে পরিচালিত করেছেন।

এই প্রক্রিয়াটা এখন বিএনপি’র মধ্যে যেমন বিএনপির বাইরেও তেমন ব্যাপকভাবে পরিচিত। সকলেই এখন জানেন, তারেক রহমান তার বাবা শহীদ জিয়াউর রহমানের মতো কম কথা বলেন এবং কাজ বেশি করতে পছন্দ করেন। তার মা বেগম খালেদা জিয়ার মত কম কথা বলেন এবং অন্যের কথা অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে শোনেন।

জিয়াউর রহমান ছিলেন সময়ের নায়ক, ম্যাজিকাল ব্যক্তিত্ব, সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, দ্রুততম সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেও রাজনীতিতে তিনি প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে পরিচিতি পাননি। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়া অনমনীয়, আপসহীন, অটল অবস্থানে থেকে নিজেকে রাজনীতির প্রতিবাদী চরিত্রে রূপান্তরিত করেছেন। জিয়াউর রহমানের ছিল প্রতিভা ও কর্মোদ্দীপনা, বেগম খালেদা জিয়ার আছে ব্যক্তিত্ব ও বিভা। তারেক রহমান সংবেদনশীল, বিনয়ী ও নমনীয়। তিনি তিলে তিলে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। বিএনপির ওপর নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিএনপি’র নেতা হয়ে উঠেছেন। দলের ঐক্য সংহতি বজায় রেখে দলটিকে নতুন ভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে এনেছেন। তার মধ্যে সকলেই একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেন, তিনি রাজনীতিতে বিএনপির ভিন্নতর অবস্থান নিশ্চিত করার ব্যাপারে আগ্রহী। বিএনপি রাজনীতির মুক্তিযুদ্ধপন্থী, মধ্যপন্থী, গণতান্ত্রিক, সহনশীল, ইনক্লুসিভ ব্র্যান্ডিং এর ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। দীর্ঘদিনের প্রবাস জীবনের কারণে তিনি গবেষণা ও ভাবনার অনেক সময় পেয়েছেন। নিজের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিকে অনেক শাণিত ও পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে পেরেছেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের ব্যাপারে তার একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। যে কারণে সংস্কারের ব্যাপারে তার ইতিবাচক মনোভাব সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে ইতোমধ্যে।

তিনি ১৭ বছর দেশের বাইরে। তার দেশ ছেড়ে যাবার সময় বিএনপি ও ছাত্রদলের যে কর্মীর বয়স ১৮ ছিল তার বয়স এখন ৩৫। যে কর্মীর বয়স ৪০ ছিল তার বয়স এখন ৫৭। যে নেতার বয়স ৫৭ ছিল তিনি এখন ৭৪। কর্মীদের অনেকেই তাকে চোখে দেখেননি। তিনিও তাদের চোখে দেখেননি। ক্যামেরায় তোলা ভিডিও স্ক্রিনে ভেসে উঠলে কতটাই বা আর দেখা যায়। কতজন নেতাই বা তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন এই ১৭ বছরে। কিন্তু লাখ লাখ তরুণ তাকে সরাসরি না দেখে অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন জেল জুলুমের পরও তার জন্য মাঠে লড়তে প্রস্তুত হয়েছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে নানা প্রলোভন এড়িয়ে দলবদল না করে মতাদর্শ না পাল্টে হাজার হাজার মানুষ তরুণ থেকে বৃদ্ধ হয়েছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শত শত নেতা আশা বাঁচিয়ে রেখে জীবনের শেষ বয়সে পৌঁছে গেছেন। সকলে মিলে বছরের পর বছর ধরে তার ফেরার অপেক্ষা করেছেন। কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের অপেক্ষা করেছেন। একটা নির্বাচনের মাধ্যমে জন রায়ের ভিত্তিতে সরকার গঠনের জন্য প্রতীক্ষা করেছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রতিবাদী ও মজলুম বেগম খালেদা জিয়াকে সকলেই জাতীয় নেতা হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন। তারেক রহমান দেশে ফেরার আগেই সকলের ভরসা হয়ে উঠেছেন। মানুষ সকল অপপ্রচার এড়িয়ে তারেক রহমানকে চিনতে পারছে।

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ইনক্লুসিভ মধ্যপন্থী রাজনীতির যে ধারা বাংলাদেশের ইতিহাসে বহমান সেটিকে তারেক রহমান তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বকালীন সময়ে আরও শক্তিশালী করে তুলেছেন।

ফলে তার দেশে ফেরা সাধারণ কোন প্রত্যাবর্তন নয়। ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন নির্মাণের দিকে যাত্রা। বাংলাদেশের পরিচিত ও আস্থাশীল রাজনীতির প্রত্যাবর্তন।

Share

Follow us