চা-শ্রমিকদের নিয়ে দু’টি গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব ও আলোচনা সভা
রওশন ঝুনু, ঢাকা : “কষ্ট নীরবে সইলে হবে না, যে ব্যক্তি এই কষ্ট লাঘব করতে পারবে তার সামনে শক্ত কন্ঠে তা তুলে ধরতে হবে। আবার লড়াই শুধু মাঠের নয়, লড়াই সর্বত্র, সবার। যখন মাঠের লড়াইয়ের সাথে জ্ঞানের লড়াইটাও যুক্ত হবে, তখনই কন্ঠ শক্তিশালী হবে। আর আজকের এই গ্রন্থ দু’টি উন্মোচনের মধ্য দিয়ে তার সূচনা হলো বলে আমি মনে করি।”
চা শ্রমিকদের নিয়ে লেখা দু’টি গ্রন্থ— ‘চা শ্রমিকের কথা এবং চা শ্রমিকের মজুরি: মালিকের লাভ, শ্রমিকের লোকসান’ এর প্রকাশনা উৎসব ও আলোচনা সভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পিপিআরসি’র নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন।
আজ ১১ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তৃতীয় তলায় আব্দুস সালাম মিলনায়তনে সোসাইটি ফর এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড), ব্রাত্যজন রিসোর্স সেন্টার (বিআরসি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি এই প্রকাশনা উৎসব ও আলোচনা সভার আয়োজন করে।
গ্রন্থ দু’টির লেখক, সম্পাদক ও সেড-এর পরিচালক ফিলিপ গাইন তার বক্তব্যে বলেন, “চা শ্রমিকের কথা বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ যখন ২০২২ সালে বের করার পরপরই ইতিহাসের এক নজিরবিহীন ধর্মঘট ঘটে যায় চা বাগানে। এর ফলে শ্রমিকদের দৈনিক নগদ মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা হয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে। এ মজুরি যথেষ্ট না হলেও চা শ্রমিকরা তা মেনে নিয়ে কাজে যোগ দেন। এই নজিরবিহীন ধর্মঘটের আগেপরে মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটতে থাকে সেসবের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ নিয়ে চা শ্রমিকের মজুরি: মালিকের লাভ, শ্রমিকের লোকসান বইটি।”
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন চা শ্রমিক প্রতিনিধি ও জুড়ি ভ্যালির সহ-সভাপতি শ্রীমতি বাউরি। “আমরা চা শ্রমিকরা আমাদের ১৫০ বছরের কষ্টের জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। ২০২২ সালে ১৯ দিনের ধর্মঘটের সময় আমরা ৩০০ টাকা মজুরি চেয়েছিলাম, কিন্তু পেলাম ১৭০ টাকা। তাও আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু বকেয়ার টাকা কেনো পুরোটা দেয়া লোল না? কিছু বাগান তো এখনও বকেয়ার টাকা পায়নি। তার উপর মালিকপক্ষ যে হিসাব দেখায়, সব সুবিধা মিলিয়ে দৈনিক মজুরি ৫৪০ টাকা, তা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না।”
“মজুরি বাড়ানোর কথা আসলেই মালিকপক্ষ বলে, তাদের পক্ষে মজুরি আর বাড়ানো সম্ভব নয়। যদি বাগান-ব্যবসায় লাভ না থাকতো তবে কেনো আপনারা বিনিয়োগ করলেন? কীভাবে একটি বাগান থেকে মালিকের দু’টি বাগান হয়? প্রশ্ন তুলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (বিইআর)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ। “আজকে যদি শ্রমিকের নিজস্ব একটা সঞ্চয় থাকতো তাহলে ধর্মঘট আরও লম্বা সময় করে পুরো ৩০০ টাকাই আদায় করতে পারতো। কিন্তু বন্দীদশায় আবদ্ধ শ্রমিকের তো সেই সামর্থ্য নেই। তারা হলো ‘দরিদ্রদের মাঝে দরিদ্র্যতম’।”
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া শ্রম আইন প্রসঙ্গে বলেন, “এই আইনের ৩২নং ধারার যদি সঠিক প্রয়োগ হয়, তবে পঞ্চম তফসিলে যেসব সুবিধার ধারা আছে, সেগুলোর প্রয়োগ নেই কেনো? আইনকে শুধু নিজের সুবিধামতন ব্যবহার করলে তো হবে না। যতোদিন শ্রমিককে বঞ্চিত রেখে শুধু চা বাগানকে সম্পদ মনে করবেন, ততোদিন সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি)-এর সম্পাদক মি. ফরিদ হোসেন বলেন, ‘আজকে যে বই দু’টোর মোড়ক উন্মোচিত হলো, আমি মনে করি এগুলো সাংবাদিকদের জন্য এক কথায় জ্ঞানকোষ। তিনি বলেন, এখানে যেমন চা শ্রমিকের কষ্টের কথা উঠে এসছে, পাশাপাশি তাদের সাফল্যেরও কিছু গল্প উঠে এসেছে। আমাদের সাংবাদিকদের দায়িত্ব দৈনন্দিন রিপোর্টিং এর পাশাপাশি সাফল্যের গল্পসমূহ তুলে ধরা।”
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মি. নৃপেন পাল, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার, চট্টগ্রাম এর সভাপতি মি. তপন দত্ত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার।
অনুষ্ঠানে আগত অতিথিবৃন্দের সাথে উন্মুক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রকাশনা ও আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘটে।