জাতীয়

অংশীদার হিসেবে পরস্পরকে পাশে চায় ঢাকা-প্যারিস

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার জন্য কৌশলগত অংশীদার প্রয়োজন বাংলাদেশের এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে আগ্রহী ফ্রান্স। অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব-বলয় বাড়ানোর অংশ হিসেবে নতুন অংশীদার প্রয়োজন প্যারিসের, তাই অন্য আরও অনেক দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও বেছে নিয়েছে ফ্রান্স। এ কারণে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত খাতে সহযোগিতা বাড়াতে রাজি দুই দেশ।

শান্তি, সমৃদ্ধি ও জনগণের জন্য উভয় দেশের অংশীদারিত্বকে কৌশলগত স্তরে নেওয়ার জন্য দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাজ করবে বলে সম্মত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।

দুই দিনের সফরে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ রবিবার (১০ সেপ্টেম্বর) ঢাকা আসেন। সোমবার দুপুরে ম্যাক্রোঁর ঢাকা ত্যাগের আগে দুই নেতার মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের পরে এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে স্বাধীনভাবে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী ঢাকা ও প্যারিস।

মোটা দাগে একদিকে বাংলাদেশের উন্নত বিশ্বে পৌছানোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং অন্যদিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের নির্ভরযোগ্য অংশীদার খোঁজার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে এই সফরের মাধ্যমে।

অবাধ, মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আলোচনার পরে ‘বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ বিবৃতি শান্তি, সমৃদ্ধি ও মানুষের জন্য অংশীদার’ ঘোষণা করা হয়।

ওই যৌথ বিবৃতিতে রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণ, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহায়তা, সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়তা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই পক্ষের সহযোগিতা ও অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলার সহায়তা এবং এয়ারবাস কোম্পানি থেকে একটি স্যাটেলাইট ক্রয় সংক্রান্ত দুটি চুক্তি হয়েছে। এছাড়া এয়ারবাস থেকে ১০টি বিমান ক্রয়ের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিরও উল্লেখ আছে বিবৃতিতে।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের যে বড় লক্ষ্য সেটি হচ্ছে উন্নত দেশ হওয়া এবং সঠিক পথই তা অনুসরণ করা হচ্ছে।’

এশিয়ার মধ্যে ভারত, চীন ও জাপানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করেছে বাংলাদেশ এবং ফ্রান্সের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করার প্রয়াসের মাধ্যমে ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করছে ঢাকা, বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্যতম বড় শক্তি ফ্রান্স এবং একইসঙ্গে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ শক্তির একটি। ফলে প্যারিসের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে সহজ হবে।’

যৌথ বিবৃতি

পাঁচ পাতার যৌথ বিবৃতিতে তিন বড় ক্ষেত্রে দুই দেশের অংশীদারিত্বের বিভিন্ন বিষয়গুলো বলা হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে সহনশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য অংশীদারিত্ব, দ্বিতীয় হচ্ছে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া, শান্তি ও নিরাপত্তার অংশীদারিত্ব এবং তৃতীয় ক্ষেত্র হচ্ছে মানুষে-মানুষে যোগাযোগে অংশীদারিত্ব।

জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। উন্নত বিশ্বের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহায়তা করবে ফ্রান্স।

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন দ্রুত অর্থ পায় সেটির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা উচিত বলে মনে করে ঢাকা ও প্যারিস।

শহীদুল হক বলেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতি মোকাবিলার জন্য উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে তহবিল চেয়েছি এবং ওই প্রক্রিয়ায় ফ্রান্সও আমাদের সঙ্গে আছে।’

অর্থনৈতিক সহযোগিতা

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠমো, বিশেষ করে রেলওয়েতে সম্ভাব্য বিনিয়োগ খুঁজে বের করার বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ। আগামী ২৩ থেকে ২৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিস ও তুলোতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনেরও সাফল্য কামনা করা হয়েছে বিবৃতিতে।

শহীদুল হক বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে ফ্রান্স বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’

ইউক্রেন যুদ্ধ

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষ করে জাতিসংঘ চার্টার লঙ্ঘন হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে, এই অভিমত প্রকাশ করেছে উভয় দেশ। যুদ্ধের পরিণতির কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ওইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উভয় দেশ তৈরি।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশে ভূমিকার প্রশংসা করেছে ফ্রান্স এবং শান্তিরক্ষা মিশনে সহায়তা করার বিষয়ে উভয় দেশ রাজি হয়েছে।

বিভিন্ন দেশে বেআইনিভাবে সামরিক সরকারের ক্ষমতা দখলকে নিন্দা জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। পাশাপাশি সংঘাত, সহিংতা ও নৃশংসতার জন্য বাস্তচ্যুতদের নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

 

রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলায় এখন থেকে সরাসরি কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফ্রান্স।

এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘কোনও গণতান্ত্রিক দেশ বেআইনিভাবে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে সমর্থন করবে না। মিয়ানমার ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এ ধরনের ঘটনার নিন্দা সবাই করেছে।’

 

সামরিক সহযোগিতা

 

২০২১ সালে দুই দেশ সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য একটি লেটার অফ ইনটেন্ট সই করেছিল। ওই সমঝোতার আলোকে বাংলাদেশের নৌ, বিমান ও টেরেস্ট্রিয়াল সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহযোগিতা বাড়াতে চায় ফ্রান্স।

এছাড়া অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি, যেমন- সুমদ্র নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়েও দুই দেশের সহযোগিতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

Share

Follow us