আওয়ামী লীগ নেতার সন্ত্রাসী মহড়া : নিরব উপজেলা প্রশাসন
জেলা প্রতিবেদক : বগুড়া জেলার কাহালু থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পাইকড় ইউনিয়ন পরিষদের (ভোট চুরির অভিযুক্ত) চেয়ারম্যান মিটু চৌধুরী গতকাল ২ সেপ্টেম্বর, সোমবার এলাকায় ভীতি তৈরী করতে সন্ত্রাসী মহড়া করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
উল্লেখ্য, মিটু চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রজেক্ট বাস্তবায়ন না করে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারী অর্থ আত্নসাতের অভিযোগ আছে। এছাড়াও, লুট, হামলা, গায়েবি মামলা দিয়ে জনগনকে নির্যাতন করে ভীতসন্ত্রস্ত করার অভিযোগ বিভিন্ন সময় উঠেলেও প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করেছে। পাইকড় ইউনিয়নের প্রায় তিনশতাধিক বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে হাজতি করেছে বলেও অভিযোগ আছে।
৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের সাথে সাথে পলাতক ছিলেন মিটু চৌধুরী, ১ আগস্ট পর্যন্ত তাকে পাইকড় ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব পালন করতে ইউনিয়ন পরিষদে আসতে দেখা যায়নি। ৩ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার মিটু চৌধুরীর বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন থেকে একটি তদ্বন্ত করার অফিসিয়াল আদেশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে, ২ সেপ্টেম্বর (সোমবার) অস্ত্রসহ ২০/৩০ টি বাইকে সন্ত্রাসীদের নিয়ে ইউনিয়নে মহড়া দিয়েছে মিটু চৌধুরী। এতে এলাকার সাধারণ, অসহায় জনগন যারা ন্যায় বিচার পাবেন আশা করেছিলেন তারা ভয়ে পরিষদে আসতে সাহস পাচ্ছেনা বলে একাধিক ভুত্তভোগী জানিয়েছেন।
আড়োলা দ্বী-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশে অনইচ্চুক তিনি জানিয়েছেন, আমরা ৩ তারিখ ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, মিটু চৌধুরীর স্ত্রীকে অবৈধ ভাবে স্কুলের লাইব্রেরিয়ান পদে চাকুরি দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে, কিন্তু আজ (সোমবার) মিটু চৌধুরী যে সন্ত্রাসী মহড়া দিলো, তাতে, সে আটক না হওয়া পর্যন্ত কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছেনা।
মিটু চৌধুরীর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়টি অবগত হয়েছেন বগুড়া জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাচিস্ট্রেট (ভারপ্রাপ্ত) মো. মেজবাউল করিম। তিনি জানিয়েছেন বগুড়া জেলায় যে ব্যক্তি বা গোষ্টি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করবে তাকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। আগামিকাল (মঙ্গলবার) মিটু চৌধুরীর বিরুদ্ধে কাহালু উপজেলা প্রশাসন একটি তদ্বন্ত দিয়েছে। তদ্বন্তের রিপোর্ট আসুক, তারপরে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তদ্বন্তে কোন অনিয়ম বা অসত্য তথ্য উঠে আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
গত ২১ আগস্ট জাতীয় দৈনিক সবুজ বাংলাদেশ, দৈনিক নববার্তা পত্রিকায় “ দূর্নীতিবাজ মিটু চেয়ারম্যানকে রক্ষার চেষ্টা করছে উপজেলা প্রশাসন শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
কাহালু উপজেলা প্রশাসনের অনিয়মের বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর এর কাছে জানতে চাওয়া হলে, তিনি জানিয়েছেন কাহালু উপজেলার অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে আমি ইতোমধ্যেই অবগত হয়েছি, প্রশাসনের ভিতর-বাহির বলে কথা নেই, যেই দুর্নীতি করবে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। রাজশাহী বিভাগের যে সকল সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
বগুড়া জেলা গয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মিটু চৌধুরীর বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য আছে, সে পাইকড় ইউনিয়নের কয়েকজন সদস্যর বাড়িতে এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে আত্নগোপনে আছেন। জেলা গয়েন্দা পুলিশ যথেষ্ট সচেতন, কাউকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করতে দেওয়া হবেনা। তিনি আরো জানিয়েছেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আত্নগোপনে থাকার ১ মাস পরে পরিষদে আসতে যদি গ্রুপ নিয়ে জন-জীবন ভীতিকর পরিস্থিতি করে থাকেন, তাহলে বিষয়টি অবশ্যই কাহালু উপজেলা ও থানা প্রশাসন খতিয়ে দেখবে।
অভিযুক্ত মিটু চৌধুরীর বিরুদ্ধে গঠিত তদ্বন্ত কমিটির সদস্য ও উপজেলা সমবায় অফিসার মো. মাহবুবর রহমান স্বক্ষরিত তদ্বন্তের সভা আহ্ববানের একটি অফিসিয়াল চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে চলচ্চিত্র পরিচালক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মনজুরুল ইসলাম মেঘ এর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই তদ্বন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছ।
এই বিষয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক মনজুরুল ইসলাম মেঘের কাছে জানতে চাওয়া হলে, ৩ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) সকাল ১০ ঘটিকায় তিনি জানিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন আমাকে (চিঠি, মোবাইল, হোয়াটসএপস, ইমেইল, মেসেঞ্জার) তদ্বন্তের বিষয়ে জানায়নি। ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্যের নাতী আমার সহকারীকে বিষয়টি জানিয়েছে, সেই ভাবে আমি জেনেছি। আনুষ্ঠানিক ভাবে কোন কিছু না পেলে সেই বিষয়ে কথা বলা ঠিক না।
কাহালু উপজেলা প্রশাসন থেকে আমাদের প্রতিবেদক নিশ্চিত হয়েছে, আবেদনকারী মনজুরুল ইসলাম মেঘ কে তদ্বন্ত বৈঠকের বিষয়ের চিঠি দেওয়া হয়নি।
উপজেলা প্রশাসনের নথি গোপন করার ঘটনা কাহালু উপজেলা প্রশাসনের এই প্রথম নয়। ওপেনপ্রেস২৪ ডটকম এর হাতে একটি অডিও রেকোর্ড এসেছে, যেটিতে কাহালু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. মেরিনা আফরোজ বলেছেন, (অন্য একটি অভিযোগের) রায়ের কপি তিনি ভুক্তভোগীকে দিয়েছেন, কিন্তু তিনি কবে দিয়েছেন এই জবাব না দিয়ে মনে নেই বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, অপর একটি অডিওতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তদ্বন্তর ফলাফল ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪ এর হলেও, রায়ের কপি ভুক্তভোগীকে উপজেলা প্রশাসন দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে গত ১৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বাদীকে উপজেলায় ডেকে নিয়ে। প্রায় ৭ মাস রায়ের কপি গোপন করায়, অসাংবিধানিক ভাবে একজন নাগরিকের সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
উপজেলা প্রশাসনের অনিয়ম ও মিটু চৌধুরী কর্তৃক দীর্ঘ দিন ইউনিয়ন পরিষদে অনুপস্থিত থাকার বিষয়টির আইনগত দিক নিয়ে কথা হয়েছে ঢাকা জর্জ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি জিয়াউর রহমান এর সাথে, তিনি জানিয়েছেন আইন অনুযায়ী কোন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কোন কারণ ছাড়া, প্রশাসনের লিখিত অনুমতি ছাড়া যদি দায়িত্বপালনে অবহেলা বা অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ সেই চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করতে পারে।
মিটু চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগে তদ্বন্ত কমিটি গঠন হয়েছে,তা হলো- তিনি ইউনিয়নের প্রত্যেক বাড়ির হোল্ডিং নাম্বারে নিজের ছবি ব্যবহার করেছেন, এবং ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দেওয়াল জুড়ে বড় করে নিজের নাম লেখে ব্যক্তিগত প্রচার করেছেন। এই বিষয়ে আইনের ব্যাখা জানতে চাইলে আইনজীবি জিয়াউর রহমান বলেন, বাড়ির হোল্ডিং নাম্বারে চেয়াম্যানের ছবি ব্যবহার গুরতর অপরাধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সাংবিধানিক লঙ্ঘন। উপজেলা প্রশাসন এতদিন কেনো এই বিষয়টিতে নজর দেয়নি সেটিও খতিয়ে দেখা উচিৎ। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দেওয়ালে নিজের বিজ্ঞাপন প্রচার নৈতিকতার অবক্ষয়। সংবিধানে উল্লেখ আছে, কি কি কারনে একজন চেয়ারম্যান বরখাস্ত হতে পারেন, তার মধ্যে এই দুটি অভিযোগের অপরাধ দৃশ্যমান।
উল্লেখ্য, মিটু চৌধুরী এলাকায় অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগের মহড়া দিতো এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দিয়েছেন আব্দুল মান্নান নামের একজন ইউটিউব কন্টেন্ট ক্রিয়েটর।
অভিযুক্ত মিটু চৌধুরীর মোবাইলে যোগাযোগ করে সংযোগ বন্ধ পাওয়া গেছে, তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তদ্বন্ত প্রক্রিয়া চলমান থাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য নেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে তদ্বন্তের ফলফলসহ ইউএনও কাহালুর বক্তব্য প্রতিবেদন দ্বিতীয়ধাপে প্রকাশ করা হবে।